মহাসড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা

মহাসড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা

মহাসড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা

জাতিসংঘ ২০১৬-২০৩০ মেয়াদে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এতে ১৭ টি অভীষ্ট লক্ষ্য (এড়ধষং) রয়েছে। এর ৩.৬ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা “২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা” এবং ১১.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা “২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সহজগম্য এবং টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ করে দেওয়া “এই দুটি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের। সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে তথ্য মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব রয়েছে। সড়কে দুর্ঘটনা পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি ঘটে। উন্নত দেশগুলো নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে সড়ক তৈরি থেকে শুরু করে ট্রাফিক সিস্টেমের আধুনিকায়ন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য বিধি-বিধান, জনসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা অনেকাংশে নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

২০১১-২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য “ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডিকেট অব রোড সেফটি অ্যাকশন প্লান” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। পাশাপাশি জাতিসংঘ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট একই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ দুই প্রকল্পের অভিন্ন লক্ষ্য হলো প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনা শতকরা ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা। জাতিসংঘ ঘোষিত “সড়ক নিরাপত্তা দশক” এসময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ সাধারণ যানবাহনের তুলনায় ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার বেশি। রাস্তা ও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যেখানে ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা প্রয়োজন সেখানে আছে মাত্র ৮ ভাগ। নিরাপদ সড়ক চাই এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৪,৭০২ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে ৫,২২৭ জন মারা গেছেন এবং আহতদের সংখ্যা ৬,৯৫৩ জন। কারো একার পক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রধান চারটি সমস্যা হলো সড়কের নকশায় ত্রুটি, চালকের অসচেতনতা, সড়ক ব্যবহারকারী জনগণের অসচেতনতা এবং ফিটনেস বিহীন যানবাহন। রাস্তাগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ব্যবহারকারী কোনো পক্ষেই আইন ভঙ্গ করার সুযোগ না পায়। এ ছাড়াও রাস্তা ব্যবহারে ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা ও সাচ্ছন্দ্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আঁকাবাকা, উঁচুনিচু ও শরু এসব পরিহার করে মশ্রিন ও চওড়া রাস্তা তৈরি করতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার হাইওয়েগুলোকে ফোর লেন করা শুরু করেছে। ঢাকা- চট্টগ্রাম ফোর লেনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ চালক পুরুষ এবং স্বল্প শিক্ষিত। তাদের ট্রাফিক রুলস সম্পর্কে ধারণা কম। ট্রাফিক রুলস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা নিজেদের এবং সড়ক ব্যবহারকারীদেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। সড়ক ব্যবহারকারীরাও অসচেতন, তারাও ট্রাফিক রুলস মানেনা। যত্রতত্র রাস্তা পার হয়, এতে করে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ফিটনেস বিহীন যানবাহন দুর্ঘটনার আর এক কারণ।

সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো জন্য সরকার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২৫ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ নির্দেশনায় “জনগণকে সচেতন করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে” মর্মে তথ্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মহামন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা এবং এসডিজি’র নির্ধারিত অভিষ্ট বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সড়ক ব্যবহারকারী সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সচেতন ও প্রশিক্ষিত করার জন্য জনপ্রিয় প্রচার কৌশলের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত গণযোগযোগ অধিদপ্তর, তথ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার ফলে জনগণ আগের তুলনায় অনেক সচেতন হলেও তা যথেষ্ট নয়। সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো জন্য ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ফিটনেস বিহীন যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। লাইসেন্স বিহীন বা ভূয়া লাইসেন্সধারী চালক যাতে গাড়ি না চালাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র যাত্রী উঠানো নামানো বন্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট স্টপেজে যাত্রী উঠা-নামা নিশ্চিত করতে হবে। গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে হবে। নিরাপদে গাড়ি চালানো জন্য চালকে অবশ্যই সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীদের ও সিট বেল্ট বাধা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ ড্রাইভিং এর জন্য সিট বেল্ট বেধে গাড়ি চালানো ও গাড়িতে চড়া গুরুত্বপূর্ণ। ড্রাইভারকে মনোযোগের সাথে গাড়ি চালাতে হবে। ড্রাইভিং এর সময় মোবাইলে কথা বলা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলা যাবে না। একটু অমনোযোগী হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। অদক্ষ বা অল্প দক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি

-২-

চালানো যাবে না। এ জন্য গাড়ির মালিকদের সর্তক থাকতে হবে। গাড়ি চালকের রাস্তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা থাকতে হবে। চালককে খেয়াল রাখতে হবে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা, লেন, প্রস্তততা ইত্যাদি। গাড়ির গতি সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, প্রতিযোগিতায় নামা যাবে না, হুটহাট করে গাড়ির গতি বাড়ানো কমানো যাবে না। গাড়ির লুকিং গ্লাসে চোখ রাখতে হবে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। নিয়মিত চোখ ও শরীর পরীক্ষা করতে হবে। একাধারে পাঁচ-ছয় ঘন্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। চালকদের বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে।

আমাদের দেশে পুরুষ গাড়ি চালককে সংখ্যা বেশি। অথচ পুরুষ গাড়ি চালকদের তুলনায় নারী চালকরা বেশি নিরাপদ ও সহনশীল। নারী চালকদের ড্রাইভিং পেশায় নিয়ে আসার জন্য ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের একটি প্রকল্প আছে “হুইলস টু ফ্রিডম ” এখানে গ্রামে অসহায় অসচ্ছলত তালাকপ্রাপ্তা নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত দেড় হাজারের ও বেশি নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছেন। সরকার পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ (২০১৮ সালের ৪৭ নম্বর আইন) প্রণয়ন করেছে, যা ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর হয়েছে।

এ আইনের উল্লেখযোগ্য বিধানগুলো হলো সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মানুষ হত্যা করলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যু দন্ডের বিধান, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান। আদালত অর্থ দণ্ড সম্পূর্ণ বা অংশ বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন। মটরযান দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়ার বিধান, নিবন্ধন ছাড়া মটরযান চালালে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধার রয়েছে। ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মটরযান চালালে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান, ভুয়া রেজিস্টেশন নাম্বার ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ৬ মাস থেকে ২ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা অর্থ দণ্ডের বিধান। ট্রাফিক সংকেত না মানলে ১ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান, সঠিক স্থানে মটরযান পার্কিং না বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য উঠানামা না করলে ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলফোনে কথা বললে ১ মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একজন প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যাবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। গণপরিবহণে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায় করলে একমাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থ বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান। এছাড়াও সংরক্ষিত আসনে অন্যকোনো যাত্রী বসালে ১ মাসের কারাদণ্ড, অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারের সারাজীবনের কান্না। কোনো বিবেকবান মানুষ একটি পরিবারের জন্য এতবড়ো ক্ষতি হোক তা কোনোভাবেই আশা করেন না। সরকার পরিবহণ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ, সড়ক ব্যবহারকারী জনসাধারণ, সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করছে। এতে করে সড়ক-মহাসড়কের শৃঙ্খলা আগের যে কোনো সময়ের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। সকল পক্ষের সম্মিতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে সড়ক-মহাসড়কের শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে এনে দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব হবে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারিত অভিষ্ট্যগুলি ২০৩০ এর পূর্বেই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

ইমদাদ ইসলাম
১৩.১০.২০২০

আপনি আরও পড়তে পারেন